রাসেলের শিক্ষা ভাবনা
শিবাজী দে
শিবাজী দে
এ যুগের অন্যতম চিন্তাবিদ বার্ট্রান্ড রাসেলের (১৮৭২-১৯৭০) প্রতিভা ও সৃষ্টির বহুমুখিতা বিস্ময়কর। অনেকের মতে, রাসেলের গাণিতিক যুক্তিবিদ্যা ও দর্শন সম্পর্কিত অবদান চিন্তার ইতিহাসে স্থায়ী পরিবর্তন সূচনা করে। গণিত শাস্ত্র এবং দর্শনে তাঁর আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও তিনি অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজ, ধর্ম, নৈতিকতা, শিক্ষা এসব নিয়েও প্রচুর লিখেছেন। তিনি গণিতের উপর তাঁর যুগান্তকারী বই 'Principia Mathematica' লিখে বিশ্ববিখ্যাত হয়েছিলেন, কিন্তু ১৯৫০ সালে 'Marriage and Morals' গ্রন্থের জন্য সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। রাসেলের লক্ষ্য ছিল সুখী, সুন্দর শান্তিপূর্ণ এক পৃথিবী। তাই মানবজীবনের সাথে জড়িত প্রায় সকল বিষয়েই তাঁর চিন্তা আবর্তিত হয়েছে। শিক্ষা সম্পর্কেও তিনি সবিশেষ গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা করেন। শিক্ষার উদ্দেশ্য, শিক্ষাপদ্ধতি, শিক্ষার বিষয়বস্তু, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কাঠামো, এর নিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়া, সমাজ গঠনে শিক্ষার ভূমিকা ও প্রভাব ইত্যাদি সম্পর্কে রাসেল এত বিস্তৃত আলোচনা করেছেন যে বর্তমান প্রবন্ধে এত স্বল্প পরিসরে রাসেলের শিক্ষাভাবনার উপর সামগ্রিক আলোকপাত করা সম্ভব নয়। তাই এখানে সংক্ষিপ্তভাবে তাঁর শিক্ষাচিন্তার কয়েকটি দিক তুলে ধরার প্রয়াস নেব।
শিক্ষার উপর রচিত রাসেলের প্রথম গ্রন্থ 'On EducationÕ (১৯২৬) এত বহুল পঠিত হয়েছিল যে, এক বছরের ব্যবধানে এই বই সাতবার প্রকাশ করতে হয়েছিল। এছাড়া শিক্ষার উপর বিশেষভাবে রচিত তাঁর অন্য গ্রন্থ MÖš’ 'Education and the Social Order'(১৯৩২) এখন পর্যন্ত অনেক বিশ্ববিদ্যালয় পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তাঁর ''Principles of Social Reconstruction'(১৯১৯) গ্রন্থে শিক্ষার উপর রচিত অধ্যায়টিও খুব প্রশংসা পায়। এছাড়া অন্যান্য গ্রন্থেও শিক্ষা সম্বন্ধে তাঁর বিভিন্ন চিন্তার প্রকাশ দেখা যায়। মুক্তবুদ্ধির চর্চা, মুক্ত আলোচনা, বিজ্ঞানসম্মত মানসিক গঠন, বিজ্ঞান মনস্কতা কিভাবে প্রকৃত শিক্ষাকে সুদৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠা দিতে পারে রাসেল তা ব্যাখ্যা করেন।
রাসেলের দৃষ্টিতে শিক্ষার উদ্দেশ্য হলো সভ্যতা, যাকে সংজ্ঞায়িত করা যায় আংশিক ব্যক্তিক ও আংশিক সামাজিক প্রেক্ষাপটে। ব্যক্তির মাঝে সভ্যতা বিকশিত হয় বৌদ্ধিক ও নৈতিক গুণাবলীর সমন্বয়ে। এছাড়া তাকে কিছু সাধারণ জ্ঞান, নিজের পেশা সংক্রান্তজ্ঞান, সাক্ষপ্রমাণ সাপেক্ষে মতামত প্রদানের ক্ষমতা, প্রেম-প্রীতি, দয়া-মায়া, হাসি-আনন্দের অনুভূতি। আর সমাজ জীবনে সভ্যতা দাবী করে আইনের প্রতি সম্মান, ন্যায়পরায়নতা, মানবজাতির কোন একটি অংশের প্রতি স্থায়ী কোন ক্ষতি না করার উদ্দেশ্য এবং উদ্দেশ্যের সাথে উপায়কে বুদ্ধিসম্মতভাবে সংগতিপূর্ণ করে তোলা।
সংগঠিত সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় জীবনে শিক্ষার সমস্যা একটি প্রাচীন সংখ্যা। আজকে যে শিশু আগামীকাল সে পরিপূর্ণ নাগরিক হবে তাই তাকে কি শিক্ষা দেয়া হবে, কি পদ্ধতি অনুসরণ করা হবে, কি শর্তাবলী থাকবে, বড় হয়ে সে কি দায়িত্ব পালন করবে, কি দায় শোধ করবে, শিশুর শিক্ষা কখন থেকে শুরু হবে এসব প্রশ্নের মূলে আছে ব্যক্তির সঙ্গে সমষ্টির সম্পর্কের প্রশ্ন। ব্যক্তির বিকাশ কি চুড়ান্তভাবে স্বাধীন হবে, না রাষ্ট্র বা সরকার তাকে নিয়ন্ত্রিত করবে এসব প্রশ্ন নিয়ে দুই হাজার বছর আগে প্লেটোও আলোচনা করেছিলেন। রাসেলের মতে, “প্রশ্ন হচ্ছে, শিক্ষার উদ্দেশ্য কি হবে? শিক্ষার উদ্দেশ্য কি উত্তম ব্যক্তিকে তৈরী করা না উত্তম নাগরিকের সৃষ্টি।.... সত্তা হিসাবে ব্যক্তি স্বাধীন, কিন্তু নাগরিক হিসাবে সে প্রতিবেশের অধীন।.... কিন্তু আমার বক্তব্য হচ্ছে, ব্যক্তি হিসাবে আমাদের চারিত্রিক যে সত্তা তাকে স্মরণ রাখা আমাদের কর্তব্য। ব্যক্তির বৈশিষ্ট্যের স্বীকৃতির ভিত্তিতে যদি আমরা নাগরিক হতে পারি, তাহলে কেবল যে আমরা নাগরিক হব তাই নয়, তাহলেই মাত্র আমরা উত্তম নাগরিক হতে পারব। রাসেল অভিমত পোষণ করেন যে শিক্ষার দুটি উদ্দেশ্য; একদিকে মন গঠন করা, অন্যদিকে নাগরিককে প্রশিক্ষণ দেয়। এথেন্সবাসীরা প্রথমটির প্রতি এবং স্পার্টাবাসীরা দ্বিতীয়টির প্রতি মনোযোগী হয়েছিল। স্পার্টাবাসীরা জয়ী হয়েছিলেন, কিন্তু এথেন্সবাসীরা স্মরণীয় হয়েছিলেন।”
রাসেলের মতে মানুষকে নাগরিক হিসাবে প্রশিক্ষণ দেয়া শিক্ষার একটি অন্যতম উদ্দেশ্য। ব্যক্তি হিসাবে ব্যক্তি স্বয়ংসম্পূর্ণ, স্বয়ম্ভর, কিন্তু একজন নাগরিক হিসাবে সে তার প্রতিবেশীদের দ্বারা, সমাজের অন্যান্যদের দ্বারা সীমাবদ্ধ। রাসেল বলেন, “একজন নাগরিকের মনোভাব হতে হবে এমন যে সে সচেতনভাবে জানবে যে, তার ইচ্ছাটাই একমাত্র ইচ্ছা নয়। তার সম্প্রদায়ের মধ্যে যত বিরোধপূর্ণ ইচ্ছা আছে তার মধ্যে একটা ঐক্য প্রতিষ্ঠা করে ইচ্ছাকে বাস্তবায়িত করতে হবে। একমাত্র রবিনসন ক্রুসো ছাড়া আমরা সকলেই নাগরিক এবং সে কারণে শিক্ষাকে এ সত্য মেনে নিয়ে ব্যাখ্যা করতে হবে।”
রাসেল ব্যক্তিকে যেমন সমাজ ও রাষ্ট্রের বাইরে ভাবতে পারেননি, তেমনি আবার সমাজ ও রাষ্ট্র যেখানেই তার সংকীর্ণ রাষ্ট্রীয়, ধর্মীয় বা শ্রেণীগত স্বার্থ দ্বারা ব্যক্তির নিজস্ব সত্তাকে খর্ব করার চেষ্টা করেছে, সেখানেই প্রতিবাদ করেছেন। “সংকীর্ণ দৃষ্টিতে দেখলে নাগরিকের শিক্ষা ব্যক্তির আপন সত্তার বিকাশে যেখানে সবচেয়ে মারাত্মক প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে, সে হচ্ছে মীমাংসাহীন প্রশ্নের ক্ষেত্রে ব্যক্তির বৈজ্ঞানিক দৃষ্টির স্ফুরণ। বিজ্ঞানের পদ্ধতি হচ্ছে প্রশ্নের পদ্ধতি আবিষ্কারের পদ্ধতি। আবিষ্কার মানেই জ্ঞানের এক অবস্থা থেকে অপর অবস্থায় উত্তরণ অর্থাৎ পরিবর্তন। বৈজ্ঞানিক মনের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই আবিষ্কারের দৃষ্টিভঙ্গিকে স্বীকার করা। তাকে বিকশিত করা। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির অর্থ বিজ্ঞানের বিধানে অনড় বিশ্বাস নয়। তার অর্থ নতুনতর বিধানের আবিষ্কারের সম্ভাবনাকে বিশ্বাস করা। কিন্তু নাগরিকের পক্ষে এই বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গী রাখা সম্ভব নয়। কারণ সে প্রাচীন ঐতিহ্য আর প্রবীণদের শাসনে আবদ্ধ। যা প্রতিষ্ঠিত ও প্রচলিত তাই তার কাছে সত্য এবং অপরিবর্তনীয়। আর যে ব্যক্তি এই প্রতিষ্ঠিত সত্যে প্রশ্ন তোলে সে নাগরিকদের কাছে ভয়ঙ্কর রাষ্ট্রবিরোধী শক্তি। তাই রাসেল যদিও সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় শিক্ষার অনিবার্যতার কথা স্বীকার করেন তবুও বলেন, “কাজেই নাগরিকত্বের শিক্ষার মধ্যে যে মারাত্মক বিপদ নিহিত রয়েছে তাকে আমরা বিস্তৃত হতে পারিনে।” রাসেল মূলত ব্যক্তি বিকাশের উপযোগী শিক্ষা ব্যবস্থাকেই কেন্দ্রে রেখে এর সাথে রাষ্ট্রীয় শিক্ষার সমন্বয়ের কথা বলেন।
রাসেল রাষ্ট্রীয় শিক্ষায় দেশপ্রেম বা জাতীয়তাবাদ শিক্ষার বিরোধী ছিলেন। রাসেলের মতে “স্কুলে বা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে সংকীর্ণ দেশ প্রেমের শিক্ষা দেয়া হয় তাতে রাষ্ট্র তথা সরকারের সমস্ত নীতি, বিশেষ করে অপর রাষ্ট্রের সাথে তার গৃহীত নীতিকে সমর্থণ নাগরিকের মজ্জাগত হয়ে দাঁড়ায়। এই সংকীর্ণ দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদ পৃথিবীকে পরস্পরবিরোধী মানব গোষ্ঠীতে বিভক্ত করে ফেলে। কারণ উগ্র জাতীয়তাবাদী মনোভাব যদি হ্রাস করা না যায় তাহলে সমগ্র সভ্যতার অস্তিত্বই বিপন্ন হয়ে পড়বে। জাতীয়তাবাদ নাগরিককে নিজের রাষ্ট্র সর্বোত্তম ও অপর সব রাষ্ট্র শত্র“ এ মনোভাবে পূর্ণ করে তোলে।.... তাই জাতীয়তাবাদের মধ্যে রয়েছে ঘৃণার বীজ আর মিথ্যার প্রচারণা। উভয় দেশপ্রেম বা জাতীয়তাবাদের শিক্ষাদান মানুষ হিসাবে ব্যক্তির চারিত্রিক বিকাশের পরিপন্থি।” রাসেল প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জাতীয়তাবাদের যে হিংস্র এবং অমানবিক ও অযৌক্তিক প্রকাশ দেখেছেন এবং এর ফলে যুদ্ধে যে ধ্বংস প্রত্যক্ষ করেছেন সেখান থেকেই বিশ্বশান্তির জন্য জাতীয়তাবাদী ভাবনা ক্ষতিকর বলে মনে করতেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বেই রাসেল আশা প্রকাশ করেছেন, “হয়তো আগামী যুদ্ধের শেষে রাষ্ট্রগুলো এই জাতীয়তাবাদের মারাত্মক পরিণামের কথা উপলব্ধি করবে এবং তখন তারা জাতীয়তাবাদের পতাকার নীচে বিভক্ত হওয়ার চেয়ে সর্বজাতির সম্মিলিত সংগঠনের পতাকাতলে সমবেত হওয়াই মানুষ হিসাবে বেঁচে থাকার একমাত্র উপায় হিসাবে গণ্য করবে। আজ হয়তো এটা আমার কল্পনা বিলাসমাত্র।” রাসেল তাই শিক্ষাব্যবস্থায় কোন সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রাধান্য না দিয়ে শিশুকে যাতে আন্তর্জাতিক মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা যায় সেদিকেই প্রাধান্য দিয়েছেন।
শিক্ষা ব্যবস্থায় ধর্মের স্থান কেমন হওয়া উচিত এ প্রসঙ্গে রাসেলের আলোচনা যদিও ইংল্যন্ড এবং ইউরোপের সমাজভিত্তিক তবুও তা প্রণিধানযোগ্য। রাসেলের মতে একটি বৈজ্ঞানিক জ্ঞান আহরণকারী রাষ্ট্র ধর্মীয় শিক্ষাকে তার সাধারণ শিক্ষার অঙ্গীভূত করতে পারেনা। এর কারণ সম্পর্কে রাসেল যে সব যুক্তি দেন তার সংক্ষিপ্ত রূপ হলো প্রথমত ধর্ম রক্ষণশীল শক্তি। ধর্ম সর্বদাই অতীতকে ধরে রাখতে চায়। নতুনকে গ্রহণে অনীহা দেখায়। দ্বিতীয়ত: ধর্ম তার বিশ্বাসীদের ভবিষ্যৎ বা পরকালের সুখ স্বাচ্ছন্দের কথা বলে, সে বিশ্বাস বিনষ্ট হলে, ব্যক্তি হতাশাগ্রস্থ হয় এবং তার জীবন অসহনীয় হয়ে উঠতে পারে। তৃতীয়ত: যেহেতু ধর্মের জোর হচ্ছে পরকালের উপর তাই অনেক সময়ই সামাজিক অন্যায় অবিচার প্রতিরোধের মনোভাব সৃষ্টির বদলে ব্যক্তিকে পরকালের আরাম আয়েশের আশ্বাসে এগুলো সহ্য করার মানসিকতা সৃষ্টি করে। চতুর্থত: ধর্ম ব্যক্তিকে আত্মবিশ্বাসী, উদ্যোগী করার বদলে অনেক ক্ষেত্রেই আত্মসমর্পণকারী এবং অতিপ্রাকৃত শক্তির ক্রীড়নকে পরিণত করে। এসব ছাড়াও রাসেলের মতে ধর্ম প্রায় সবক্ষেত্রেই জ্ঞান, বুদ্ধি বা প্রশ্নের প্রশংসা না করে বরং অনুৎসাহিত করে। তাছাড়া ধর্মীয় শিক্ষা মানুষের মনকে নতুন চিন্তা, নতুন জিজ্ঞাসা, নতুন আবিষ্কারের প্রতি বিমুখ করে তোলে। রাসেল মনে করেন এমনকি নীতিবোধ গঠনেও রাষ্ট্রের শিক্ষা ব্যবস্থায় ধর্মের স্থান থাকা আবশ্যক নয়। কারণ ধর্মকে আশ্রয় করে নীতিবোধটিকে তাকলে সেক্ষেত্রে ব্যক্তির আত্মনির্ভরশীলতা নষ্ট হয়ে যায়। সে ব্যক্তি নির্বিচারে ধর্মীয় কর্তৃত্বে বিশ্বাসী হযে বৌদ্ধিক গুণাবলীর অবমূল্যায়ন করে। রাসেল তাই ধর্মকে নৈতিকতার ছড়মূল থেকে সরিয়ে সেখানে প্রতিস্থাপন করেছেন ভালবাসা ও জ্ঞানকে। মানুষের ভবিষ্যৎ পূর্ণতার জন্য জ্ঞান, আবেগ, উচ্ছ্বাস, শক্তি এবং সেইসাথে সৃজনী তাড়না ও অন্যের প্রতি মর্যাদাবোধ এগুলো যথাসম্ভব বাড়ানোর ব্যবস্থা শিক্ষার একটা উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। রাসেলের মতে ধর্মীয় প্রাতিষ্ঠানিকতার জন্য ধর্মের প্রেমের দিক অপেক্ষা ধর্মান্ধতা ও গোঁড়ামীই বৃদ্ধি পায়। এই অন্ধবিশ্বাস এবং অসহনশীলতা শুধু উত্তেজনা ও উদ্বেগ বৃদ্ধি করে; কোন ন্যায় বা শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারেনা বরং যুদ্ধ ও ধ্বংসই বয়ে আনে। তাই রাসেল মন্তব্য করেন, “আমি নিঃসন্দেহে বলতে পারি যে ভাবীকালে মানুষ তথাকথিত ধর্মীয় বিশ্বাস ও আদর্শের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে অংশগ্রহণ করতে রাজী হবেনা; বরং আগামী দিনের মানুষ একটি প্রজ্ঞাশীল শান্তিপূর্ণ সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে সচেষ্ট হবে।” সমষ্টির কল্যাণের জন্য আবশ্যক উদারতা ও পক্ষপাতহীনতা। কিন্তু গতানুগতিক প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মগুলোও এর অভাবের ফলেই ধর্মীয় গোড়ামী সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ এবং শ্রদ্ধাশীল নয়। এসব নানা দিক বিশ্লেষনে রাসেল শিক্ষাব্যবস্থায় ধর্মের অন্তর্ভুক্তির বিরোধীতা করেন।
রাসেলের শিক্ষাচিন্তায় স্বাধীনতার ধারণা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রাসেল মনে করেন চিন্তার স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে পারলেই শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য অনেকটাই সাধিত হবে। রাসেলের মতে চিন্তা ও মতামতের জগতটা যে কোন ধরণের নিয়ন্ত্রণের সম্পূর্ণ অনুপযোগী। চিন্তাজগত যতদূর সম্ভব স্বাধীন ও স্বতঃস্ফূর্ত অভিব্যক্তির উপযোগী হওয়া উচিত। শিক্ষা ও মানবজীবনের জন্য যা প্রয়োজন তা হলো ব্যক্তিগত উদ্যম এবং সেক্ষেত্রে রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত এমন শিক্ষা প্রদান যা দ্বারা ব্যক্তি মননের স্বাতন্ত্র্য রক্ষিত হয়। শিক্ষাগ্রহণের আকাক্সক্ষা মানুষের একটি সহজাত আকাক্সক্ষা। এই সহজাত প্রবণতার কারণেই আনন্দচিত্তে শিশু শিখতে থাকে। তবে বড়রা উৎসাহ এবং প্রশংসা দিয়ে শিশুদের শিক্ষার কাজটি সহজতর করে দেয়। কিন্তু শিশু যখন একটু বড় হয়, নিজে নিজে নিজস্ব কাজগুলো করতে পারে তখন শিশুদের ক্ষেত্রে পূর্ণ স্বাধীনতা দিযে শুরু করাটা অনেকক্ষেত্রেই বিপজ্জনক। স্বাধীনতার সাথে পরিহারযোগ্য অবস্থাগুলোকে গুলিয়ে ফেলে তারা গঠনমুলক কিছু করতে অপারগ হতে পারে। রাসেলের মতে, “সুস্থ জীবনবোধের ধারণা ও পরিবেশের সঙ্গে জীবনকে খাপ খাইয়ে নেয়ার মতো করে বেড়ে উঠবার জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয়তা এবং কিছু পরিমাণ শাসন শিশুর জন্য অপরিহার্য।” রাসেল স্বীকার করেন যে, শিক্ষাঙ্গনে কিছু পরিমাণ আনুগত্য ও শৃঙ্খলা থাকা অপরিহার্য, কিন্তু আনুগত্যের খাতিরে আনুগত্য বা শৃঙ্খলা প্রদর্শন কখনো কাম্য হতে পারেনা।
শিশুর পূর্ণ বিকাশ ঘটিয়ে তাকে শিক্ষিত করে তোলার দ্বায়িত্ব যে শিক্ষকের তার মাঝে থাকা প্রয়োজন শ্রদ্ধা ও সম্মানবোধ। উষ্ণ অনুভূতি দিয়ে শিক্ষককে বুঝতে হবে শিক্ষার্থীর সীমাবদ্ধতাটা কোথায়। শিক্ষকের কর্তব্য এই নয় যে তিনি ছাত্রকে কোন ছাঁচে ঢেলে তৈরি করবেন। প্রতিটি মানুষ তার নিজের জীবনের রূপকার। ছাত্র স্বাধীনভাবে নিজের জীবন গড়ে তুলবে। শিক্ষক কেবল তার হাতকে সবল করে তুলবেন। ব্যক্তির জীবনের উদ্দেশ্য এমন নয় যে তা রাষ্ট্র বা কোন কর্তৃপক্ষ বা কোন প্রতিষ্ঠান তার উপর চাপিয়ে দিতে পারে। বরং এই উদ্দেশ্য থাকে তার নিজের মাঝে স্বীয় উদ্যমে উদ্ভাসিত। শিক্ষকের এই সত্যটি বুঝতে হবে তবেই তিনি পারবেন স্বাধীনতার নীতিকে খর্ব না করে প্রকৃত শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করতে। “তবে শিক্ষার্থীর জন্য স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হলে শিক্ষককে হতে হবে স্বাধীনÑ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে।”
রাসেলের মতে আধুনিক বিশ্বে যে কোন ধরণের বিজয় বা প্রাপ্তির জন্য বিনয়ের চেয়ে বৃদ্ধির ভূমিকা অধিক। বিনাবিচারে কোনকিছু গ্রহণ করে নেয়ার শিক্ষা মানবিক অবক্ষয়কে ত্বরান্বিত করে। সামান্যতম অগ্রগতির জন্য মুক্ত স্বাধীন অনুসন্ধিৎসা অপরিহার্য। বিশ্বাস স্থাপনের পরিবর্তে কোন শিক্ষা যদি গঠনমূলক সন্দেহের জন্ম দেয়, তা থেকে যদি অগ্রযাত্রা সাহসিকতার মহিমায় উজ্জ্বল হয় তবেই সে শিক্ষা প্রকৃত শিক্ষা। যদি শিক্ষাপ্রদানের নামে মানুষের প্রকৃত আকাক্সক্ষাগুলোকে লালন না করে কোন ছাঁচে ঢেলে অন্য কোন উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য যখন ব্যক্তিকে ব্যবহার করা হয় তখনই দেখা দেয় ব্যক্তিমনের অপূর্ণতা ও অসন্তোষ- এবং এ থেকে সৃষ্টি হয় সামাজিক বিশৃংখলা।
রাসেল শিশুদের ভয় দেখিয়ে শাসন করে কিছু শিক্ষাদানের বিরোধী ছিলেন। রাসেলের মতে, বিভিন্ন নিষ্ঠুর মতবাদের মনস্তাত্ত্বিক ভিত্তি খুঁজলে দেখা যায় ‘ভয়’ই হলো এসব মতবাদের প্রধান উৎস। এজন্য রাসেল শিশুদের জন্য শিক্ষার পরিবেশ তৈরিতে ‘ভয়'কে দূরীভূত করতে চেয়েছেন। শিশুদের সমস্ত ভয় এবং ধ্বংসাত্মক প্রবৃত্তি থেকে মুক্ত করলেই ভবিষ্যতে তাদের কাছে জ্ঞানের রাজ্য খুলে দেয়া সম্ভব। রাসেলের মতে, হাজারো প্রাচীন ভয় মানুষের স্বাধীন ও সুখী হওয়ার পথে বাঁধার সৃষ্টি করে। কিন্তু ভালবাসা ভয়কে জয় করতে পারে। শিশুদের ভালবাসার মাধ্যমেই ভবিষ্যতে সুখী সুন্দর বিশ্ব গড়ে তোলা সম্ভব।
রাসেল শিক্ষার সাথে সংশ্লিষ্ট যাবতীয় বিষয় নিয়েই সুচিন্তিত মতামত প্রকাশ করেন। রাসেল তার পতœী ডোরা ব্লাকের সঙ্গে যৌথভাবে ১৯২৭ সালে একটি শিশু শিক্ষালয় প্রতিষ্ঠা করেন যা পরবর্তীতে রাসেলের বেকনহিল স্কুল নামে খ্যাতি লাভ করে। এই স্কুলকেই তিনি তাঁর শিক্ষা সংক্রান্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষার জায়গা হিসেবে ব্যবহার করেন। শিক্ষাপদ্ধতি, শিক্ষার উদ্দেশ্য, বিষয় নির্বাচন, শিক্ষা ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ এসব বিষয় তিনি সুন্দরভাবে তুলে ধরেন তাঁর বিভিন্ন গ্রন্থে। এসবের বাইরে মূল্যবোধের সামাজিক উৎস সম্বন্ধেও রাসেল সচেতন ছিলেন। শুধুমাত্র নৈতিক বক্তৃতা দিয়ে সমাজের মূল্যবোধ বদলানো যায় না। শুধু শিক্ষার মধ্য দিয়েও নয়। সমাজে প্রচলিত নৈতিক ব্যবস্থাই শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রতিফলিত হয়। প্রচলিত নৈতিক ব্যবহার শ্রেণীচরিত্রের মত শিক্ষারও শ্রেণীচরিত্র শিক্ষার প্রকৃত লক্ষ্য অর্জনে বাঁধার সৃষ্টি করে এবং মিথ্যার প্রচারণাকে পরোক্ষে উৎসাহিত করে। যেমন বিত্তের অসংগতিকে বুদ্ধির অসংগতি হিসাবে ভাবার প্রবণতা কেবল বিত্তবানদের সংস্কার হিসাবে আবদ্ধ থাকেনা, এ সংস্কার শিক্ষা পরিকল্পনার অধিকর্তাদের তথা সামগ্রিকভাবে সমাজের মানসিকতাকেও আক্রমণ করে। বৃহত্তর সমাজের মত শিক্ষায়তনের পরিবেশেও বিত্তবানের ঔদ্ধত্য ও দরিদ্রের দীনতাই স্বাভাবিকভাবে প্রশ্রয় পেতে তাকে। যা মূলত: মনুষ্যত্বের পক্ষে অবমাননাকর তথা শিক্ষার লক্ষ্যের পরিপন্থী। তাই রাসেলের মতে অন্যায়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত সমাজে শিক্ষার নৈতিক দিকটি যেমন হওয়া উচিত, তেমন কখনই হয়না।
রাসেল যদিও আশাবাদী ছিলেন যে সুস্থ সমাজের অনেক লক্ষণের মধ্যে একটি হলো ঐ সমাজে সহমর্মিতা ও সহযোগিতার আবেগ দ্বেষ বা ঘৃণার আবেগকে স্থানচ্যূত করে সামাজিক পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করে। ঘৃণা ও দ্বন্দ্বকে নিষ্প্র্রয়োজনীয় ও নির্মুল করতে পারার মধ্যেই সমাজের মুক্তি। কিন্তু শুধু রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কাঠামো বদলে ফেলার চেষ্টাতেই এই লক্ষ্যে উপনীত হওয়া যাবেনা। শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে সুচারু আবেগ ও সৃষ্টিময়তার উন্মেষের উপর জোর দিতে হবে বলে রাসেল মনে করেন।
রাসেল জ্ঞান ও ভালবাসাকেই ভবিষ্যৎ সমাজের চালিকাশক্তি হিসাবে ভেবেছেন। ব্যক্তির চেতনাতেই এই জ্ঞান ও ভালবাসা সত্যতা পায়। রাসেলের শিক্ষাচিন্তার মূলেও আছে ব্যক্তি। রাসেলের শিক্ষাদর্শনে ব্যক্তির অনন্যতা ও তার আবেগগত প্রয়োজনের কথা মনে রেখে ‘শ্রদ্ধাবোধ’কে শিক্ষাপদ্ধতির ভিত্তি বলে নির্দেশ করা হয়েছে। রাসেলের ভাষায় “সমষ্টিতে নয় ব্যষ্টিতেই চুড়ান্ত মূল্যমান আরোপ করতে হবে।”
রাসেল ছিলেন মানবতাবাদী দার্শনিক। মানব কল্যাণের লক্ষ্যেই তিনি শিক্ষা ব্যবস্থার পুনর্বিন্যাসে মনোযোগী হন। যদিও রাসেলের শিক্ষাচিন্তাকে পূর্ণাঙ্গ শিক্ষাতত্ত্ব বলা যায় না। শিক্ষায় পরিপূর্ণ স্বাধীনতাও অনেক ক্ষেত্রে বিরূপ ফল বয়ে আনে যার জন্য রাসেল নিজেও কিছুটা নিয়ন্ত্রিত স্বাধীনতার পক্ষে যুক্তি দেখিয়েছেন। আবার শিক্ষায় ধর্মের ভূমিকা ন-ঞর্থক বলে রাসেল মন্তব্য করলেও ধর্মের কিছুটা সদর্থক দিকের কথা অনেক মনীষী যেমন ডেল কার্নেগি, মনোবিজ্ঞানী ডা: এ. এ. ব্রিল প্রমুখ স্বীকার করেন। রাসেল নিজেও ধর্মের প্রেমের দিককে গুরুত্ব দিয়ে দেখেছেন। এসব নানা সমালোচনা করা গেলেও রাসেলের শিক্ষাচিন্তাকে মোটেও খাটো করে দেখার উপায় নেই। আধুনিক সুখী ও সমৃদ্ধশালী সমাজ গড়ার ক্ষেত্রে রাসেলের শিক্ষাচিন্তা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা গ্রহণে দিক-নির্দেশনা দিতে পারে। আজ যে মানবতার অপমান, মূল্যবোধের অবক্ষয় সমগ্র বিশ্বকে গ্রাসকরতে চলেছে, তা থেকে মুক্তির পথ শুধুমাত্র বিজ্ঞানের আবিষ্কার দেখাতে পারবেনা। তা পারে শিক্ষা - যে শিক্ষা মানব প্রেমে উদ্বুদ্ধ প্রতিটি ব্যক্তির মুক্তবুদ্ধির চর্চাকে অনুপ্রাণিত করবে। অতীতের নিস্ক্রয়তাকে পরিহার করে সৃজনশীল ভবিষ্যৎ গড়ার আদর্শে শিক্ষা হবে যুগধর্মী, প্রগতিশীল - যা হয়তো রাসেলের কল্পনার বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্রের পথে এগিয়ে যাবে। সবশেষে বলা যায় রাসেল থেকে আমাদের শিক্ষা সমস্যার সমাধান পাব তা নয়; তবে আমাদের শিক্ষা-সংক্রান্ত যাবতীয় সমস্যার উপায় সন্ধানে রাসেলের শিক্ষা চিন্তা আমাদের সহায়তা করবে, দিক নির্দেশনা দিতে পারবে। যার মূল্য আমাদের বর্তমান সময়ের প্রেক্ষিতে অপরিসীম।
গ্রন্থপঞ্জি:
- Russell B. - Education and the Social Order
- " - On Education
- " - The Scientific Outlook
- " - Authority and the Individual
- " - Sceptical Essays
- বার্ট্রান্ড রাসেল - সম্পাদক মফিজউদ্দিন আহমেদ, নতুন সংস্করণ সম্পাদক: খানম মমতাজ আহমেদ, মনন সমিতি, দর্শন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
- দর্শন ও প্রগতি - ১৪ শ বর্ষ ১ম ও ২য় সংখ্যা জুন-ডিসেম্বর ১৯৯৭
- দর্শন - বাংলাদেশ দর্শন সমিতির পত্রিকা ১৯৯৬
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ, আব্দুলপুর সরকারি কলেজ, আব্দুলপুর, নাটোর।
No comments:
Post a Comment